বৃহস্পতিবার ২৬ জুন ২০২৫ - ১০:২৬
ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর শাসনব্যবস্থার মৌলিক নীতি

ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর শাসনব্যবস্থা মূলত মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শাসনব্যবস্থারই অনুসরণ। যেভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর যুগে সবধরনের জাহেলিয়াতের (অজ্ঞতার) বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে খাঁটি ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করেন, ঠিক তেমনি ইমাম মাহদী (আ.ফা.)’ও তাঁর আগমনের পর আধুনিক জাহেলিয়াতের—যা প্রাচীন জাহেলিয়াতের চেয়েও বেদনাদায়ক—মূল উচ্ছেদ করে ইসলামী ও ঐশী মূল্যবোধগুলোকে তার ধ্বংসস্তূপের ওপর গড়ে তুলবেন।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: প্রত্যেক শাসকের একটি স্বতন্ত্র শাসন কৌশল থাকে, যা তার সরকারের পরিচয় বহন করে। ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-ও যখন বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব গ্রহণ করবেন, তাঁর নিজস্ব কৌশল থাকবে, যেটা মূলত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কৌশলেরই প্রতিচ্ছবি হবে।

ইমাম সাদিক (আ.) বলেন,
یَصْنَعُ کَمَا صَنَعَ رَسُولُ اَللَّهِ صَلَّی اَللَّهُ عَلَیْهِ وَ آلِهِ یَهْدِمُ مَا کَانَ قَبْلَهُ کَمَا هَدَمَ رَسُولُ اَللَّهِ صَلَّی اَللَّهُ عَلَیْهِ وَ آلِهِ أَمْرَ اَلْجَاهِلِیَّةِ وَ یَسْتَأْنِفُ اَلْإِسْلاَمَ جَدِیداً
তিনি যেভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) কাজ করেছিলেন, তেমনিভাবে কাজ করবেন; যেমন রাসূল (সা.) জাহেলিয়াতের ধ্বংস করে ইসলামকে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তিনিও তেমনই করবেন। [আল-গায়বা, নু’মানী, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২৩০]
 

জিহাদি ও সংগ্রামী কৌশল
ইমাম মাহদী (আ.ফা.) তাঁর বৈশ্বিক বিপ্লবের মাধ্যমে কুফর ও শির্কের ভিত্তিমূল উপড়ে ফেলবেন এবং সবাইকে ইসলামের পথে আহ্বান জানাবেন।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
سُنَّتُهُ سُنَّتِی یُقِیمُ النَّاسَ عَلَی مِلَّتِی وَ شَرِیعَتِی
তাঁর পদ্ধতি হবে আমার পদ্ধতির মতো; তিনি মানুষকে আমার দ্বীন ও শরীয়তের ওপর প্রতিষ্ঠিত করবেন।
[কামালুদ্বীন, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৪১১]

তাঁর আন্দোলনের সময় সকল জাতির ওপর হুজ্জাত স্পষ্ট হবে। এমনকি তিনি বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে তাদের নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থের হুকুম-আহকাম অনুযায়ী বিচার করবেন।

রেওয়াতে রয়েছে:
یَسْتَخْرِجُ التَّوْرَاةَ وَ سَائِرَ کُتُبِ اللَّهِ عَزَّ وَ جَلَّ مِنْ غَارٍ بِأَنْطَاکِیَةَ وَ یَحْکُمُ بَیْنَ أَهْلِ التَّوْرَاةِ بِالتَّوْرَاةِ وَ بَیْنَ أَهْلِ الْإِنْجِیلِ بِالْإِنْجِیلِ وَ بَیْنَ أَهْلِ الزَّبُورِ بِالزَّبُورِ وَ بَیْنِ أَهْلِ الْقُرْآنِ بِالْقُرْآنِ

তিনি আনতাকিয়ার এক গুহা থেকে তাওরাত ও অন্যান্য আসমানি কিতাবসমূহ বের করবেন এবং তাওরাত অনুসারে তাওরাতের অনুসারীদের, ইনজিল অনুসারে ইনজিলের অনুসারীদের, জাবুর অনুসারে জাবুরের অনুসারীদের, এবং কুরআন অনুসারে মুসলমানদের মধ্যে বিচার করবেন। [আল-গায়বা, নু’মানী, পৃষ্ঠা- ২৩৭]

বিচারব্যবস্থার কৌশল
ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হবে বিশ্বজুড়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। এর জন্য তিনি শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা প্রয়োগ করবেন। এই ব্যবস্থায় তিনি ইমাম আলী (আ.)-এর কৌশল অনুসরণ করবেন এবং মানুষের অধিকার উদ্ধার করে তা যথাযথ ব্যক্তির হাতে তুলে দেবেন।

অনেক হাদিসে আছে, ইমাম মাহদী (আ.ফা.) বিচার করবেন নবী দাউদ ও সুলায়মান (আ.)-এর মতো; যেখানে সাক্ষীর প্রয়োজন হবে না, বরং তিনি ঈশ্বরপ্রদত্ত জ্ঞানের মাধ্যমে বিচার করবেন।

ইমাম সাদিক (আ.) বলেন,
إذا قام قائم آل محمد حکم بحکم داود وسلیمان لا یسأل الناس بینة
যখন কায়েম (আ.) আত্মপ্রকাশ করবেন, তিনি দাউদ ও সুলাইমান (আ.)-এর মতো বিচার করবেন এবং মানুষের কাছ থেকে সাক্ষ্য চাওয়া হবে না। [বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড- ৫২, পৃষ্ঠা- ৩২০]

প্রশাসনিক কৌশল
শাসন ব্যবস্থার মূলভিত্তি হচ্ছে দক্ষ ও বিশ্বস্ত প্রশাসক। ইমাম মাহদী (আ.ফা.) প্রশাসন পরিচালনায় এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ করবেন, যারা যোগ্য, সৎ ও নিষ্ঠাবান।

রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন,
سُنَّتُهُ سُنَّتِی یُقِیمُ النَّاسَ عَلَی مِلَّتِی وَ شَرِیعَتِی
মাহদী’র বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি তাঁর কর্মচারীদের সঙ্গে কঠোর হবেন, দানশীল হবেন এবং গরীবদের প্রতি দয়ালু হবেন। [মু’জাম আহাদিস ইমাম মাহদী (আ.ফা.), খণ্ড- ১, পৃষ্ঠা- ২৪৬]
 

অর্থনৈতিক কৌশল
ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর অর্থনীতি হবে সম্পূর্ণ ন্যায়ের ভিত্তিতে, যেখানে ধনী-গরিব, শ্রেণি বৈষম্য ও সুবিধাবাদিতা থাকবে না। রাষ্ট্রীয় সম্পদকে সকলের জন্য সমভাবে ব্যয় করা হবে।

রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন,
اِذا قامَ قائِمُنا اضْمَحَلَّت الْقَطائِعُ فَلاقَطائِع
যখন আমাদের কায়েম আত্মপ্রকাশ করবেন, তখন সব ধরনের জমির বিশেষ বরাদ্দ বাতিল হয়ে যাবে; এমন কোনো ব্যক্তিগত জমি (যেমন, রাজা-বাদশা, জমিদার...) থাকবে না। [বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড- ৫২, পৃষ্ঠা- ৩০৯]

ইমাম (আ.)-এর আর্থিক নীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো—তিনি সমাজের সকল মানুষের ভৌত প্রয়োজন পূরণ এবং তাদের জন্য একটি মর্যাদাপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য জীবনমান গড়ে তোলার লক্ষ্যে জনগণের মাঝে প্রচুর সম্পদ বিতরণ করেন। তাঁর শাসনামলে, যে কোনো দরিদ্র বা অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি যদি তাঁর কাছে সাহায্য চায়, সে পর্যাপ্ত পরিমাণে সহায়তা ও সম্পদ লাভ করে।

রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন,
یکون فی آخر أمتی خلیفة یحثو المال حثوا
আমার উম্মতের শেষে এমন এক খলিফা আসবেন, যিনি (অভাবগ্রস্থদের মধ্যে) সম্পদ ঢেলে দেবেন। [মু’জাম্ আহাদিস ইমাম আল-মাহদী (আ.ফা.), খণ্ড- ১, পৃষ্ঠা- ২৩২]

ব্যক্তিগত জীবনধারা
ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর ব্যক্তিগত জীবন এবং জনগণের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ধারা এক আদর্শ ইসলামী শাসকের প্রতিচ্ছবি। তাঁর দৃষ্টিতে শাসনক্ষমতা কোনো ধন-সম্পদ অর্জনের মাধ্যম বা শোষণ-জুলুমের হাতিয়ার নয়; বরং এটি মানুষের সেবা করার এবং তাদেরকে আত্মিক ও মানবিক পূর্ণতার শিখরে পৌঁছে দেওয়ার একটি পবিত্র দায়িত্ব।

নিঃসন্দেহে সেই ন্যায়পরায়ণ ইমাম যখন শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবেন, তাঁর শাসনব্যবস্থা নবী করিম হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর শাসনের জীবন্ত প্রতিফলন হবে। যদিও সমস্ত সম্পদ ও ধন-ভাণ্ডার তাঁর অধীনে থাকবে, তিনি ব্যক্তিগত জীবনে অতি সরল জীবনযাপন করবেন এবং সর্বনিম্ন পর্যায়ের ভোগে সন্তুষ্ট থাকবেন।

ইমাম সাদিক (আ.) বলেন,
فَوَ اَللَّهِ مَا لِبَاسُهُ إِلاَّ اَلْغَلِیظُ وَ مَا طَعَامُهُ إِلاَّ اَلشَّعِیرُ اَلْجَشِبُ
আল্লাহর কসম! তাঁর পোশাক হবে খসখসে, খাদ্য হবে মোটা ও নিরস জো (রুটি)। [আল-গায়বা, শেইখ তূসী, খণ্ড- ১, পৃষ্ঠা- ৪৫৯]

ইমাম জাফর সাদিক (আ.) [ইমাম মাহদী (আ.ফা.)] আরও বলেন,
اِنَّ قائِمَنا اِذا قامَ لَبِسَ لِباسَ عَلِی وَ سارَ بِسیرَتِهِ
আমাদের কায়েম যখন আত্মপ্রকাশ করবেন, তিনি ইমাম আলী (আ.)-এর পোশাক পরিধান করবেন এবং তাঁর পথ অনুসরণ করবেন। [ওয়াসায়েলুশ শিয়া, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ১৭]

এই মহান বৈশিষ্ট্যগুলোর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর নেতৃত্ব কেবল ন্যায়বিচার ও সমতা প্রতিষ্ঠার নয়, বরং তা মানবতার প্রকৃত কল্যাণ ও আত্মিক উৎকর্ষের পথপ্রদর্শক। তাঁর ব্যক্তিগত সাধাসিধে জীবনধারা এবং জনগণের প্রতি গভীর মমত্ববোধ এক আদর্শ শাসকের নিখুঁত উদাহরণ, যিনি নিজেকে ক্ষমতার সিংহাসনে নয়, বরং মানুষের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। তাঁর আগমনই হবে মানবজাতির জন্য সত্যিকারের শান্তি, ন্যায় ও মুক্তির সুবাতাস।

এই আলোচনা ধারাবাহিকভাবে চলবে...

গ্রন্থসূত্র: নেগীনে অফারিনেশ বই থেকে (ঈষৎ সম্পাদিত ও পরিমার্জিত)

Tags

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha